ব্যাংকগুলোর অলস অর্থ কমছে:সিংহভাগ যাচ্ছে শেয়ারবাজারে
ব্যাংকগুলোতে উদ্বৃত্ত তারল্যের (অবিনিয়োগকৃত তারল্য বা অলস অর্থ) পরিমাণ কমছে। গত অর্থবছরের শেষ মাস জুনে ব্যাংকগুলোতে সব মিলিয়ে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল ৩৪ হাজার ৪৯৮ কোটি ৭৩ লাখ টাকা। জুলাইয়ে ছিল ৩৩ হাজার ১২৭ কোটি ৫৬ লাখ টাকা। আগস্ট শেষে তা কমে ২৯ হাজার ৯০০ কোটি ৮১ লাখ টাকায় নেমে এসেছে। বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এই তারল্য একপর্যায়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গিয়েছিল। অর্থনীতিবিদরা বলেছেন, দেশে বিনিয়োগ বাড়ার কারণে ব্যাংকগুলোড উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমাণ কমছে। ভবিষ্যতে এ তারল্যের পরিমাণ আরো কমে আসবে বলে আভাস দিয়েছেন তাঁরা। তবে এ বিনিয়োগের পুরোটা উৎপাদনশীল বা শিল্প খাতে যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের যথাযথ মনিটরের অভাবে একটি সিংহভাগ অর্থ শেয়ারবাজারে চলে যাচ্ছে বলে অভিযোগ করেছেন তাঁরা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, গত জুনে সরকারি মালিকানাধীন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় অবিনিয়োগকৃত তারল্যের পরিমাণ ছিল ১৫ হাজার ২৬৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা। আগস্টে তা কমে ১২ হাজার ৭৩৭ কোটি ৪২ লাখ টাকায় নেমে এসেছে। বেসরকারি খাতের সাধারণ ব্যাংকগুলোতে আগস্ট শেষে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৮২৬ কোটি ৯১ লাখ টাকা। জুন শেষে ছিল ৯ হাজার ৮২০ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। বেসরকারি ইসলামী ব্যাংকগুলোতে জুনে উদ্বৃত্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল চার হাজার ২৮৬ কোটি ১৩ লাখ টাকা। আগস্টে তা কমে তিন হাজার ৮৮১ কোটি ৫০ লাখ টাকায় দাঁড়িয়েছে। বিদেশি ব্যাংকগুলোয় আগস্ট শেষে অবিনিয়োগকৃত তারল্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তিন হাজার ৩৬৭ কোটি ১০ লাখ টাকা। জুনে ছিল চার হাজার ৫১৬ কোটি ৫২ লাখ টাকা। বিশেষায়িত ব্যাংক বেসিক ব্যাংকে জুনে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ ছিল ৬০৭ কোটি ২৯ লাখ টাকা। আগস্টে তা কমে মাত্র ৮৭ কোটি ৮৮ লাখ টাকায় নেমে এসেছে।বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দুর্নীতি, অবৈধ স্থাপনা, কর ফাঁকিসহ নানা ধরনের অভিযানের কারণে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে স্থবিরতা নেমে আসে। দুর্নীতির অভিযোগে দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের কারাগারে পাঠানো হয়। সে সময় নতুন বিনিয়োগ তো দূরের কথা, বড় বড় অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠানের উৎপাদন কর্মকাণ্ডও বন্ধ হয়ে যায়। বিনিয়োগ না হওয়ায় ব্যাংকগুলোতে অলস টাকার (অতিরিক্ত তারল্য) পাহাড় জমে যায়। ওই সময় একপর্যায়ে ব্যাংকগুলোতে অলস অর্থের পরিমাণ ৩৮ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যায়। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর পরিস্থিতির উন্নতি হতে শুরু করে। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরা জেল থেকে বেরিয়ে আসেন। ব্যবসা-বাণিজ্যে আবার মনোনিবেশ করেন। সবার মধ্যে আস্থা ফিরে আসতে শুরু করে। বিনিয়োগও আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে।
তবে এ বিনিয়োগের পুরোটা উৎপাদনশীল বা শিল্প খাতে হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অর্থনীতিবিদ মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। গতকাল সন্ধ্যায় তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, 'এ কথা ঠিক যে, দেশে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে যে স্থবিরতা ছিল তা ধীরে ধীরে কেটে যাচ্ছে। শিল্প স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় মূল্যধনী যন্ত্রপাতি আমদানি বেড়েছে। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের মধ্যে আস্থা ফিরে এসেছে। এ কারণে ব্যাংকগুলোতে পড়ে থাকা অবিনিয়োগকৃত তারল্যের পরিমাণও কমছে। তবে এ অর্থের একটি সিংগভাগ অর্থ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ হচ্ছে বলে আমার মনে হচ্ছে। আর এ কারণেই সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ ছাড়াই শেয়ারের দাম হু হু করে বাড়ছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের কঠোর মনিটর করা উচিত বলে আমি মনে করি।' তিনি বলেন, 'ইদানীং ব্যাংকগুলো যে ঋণ বিতরণ করছে, তা ঠিকমতো তদারকি করা হচ্ছে না। এমনও দেখা গেছে, অনেকে শিল্প স্থাপনের জন্য ঋণ নিয়ে সেই টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছে। আর এ কারণে গত ছয় মাসের হিসাবে দেখা গেছে শিল্প ঋণ বাড়লেও শিল্প খাতের উৎপাদন বাড়ছে না।' এসব বিষয় বিবেচনায় রেখে ব্যাংকগুলোর বিতরণ করা ঋণ কেন্দ্রীয় ব্যাংককে কঠোরভাবে মনিটর করার পরামর্শ দিয়েছেন ফরাসউদ্দিন। তিনি বলেন, গত কয়েক মাসে ব্যাংকগুলো বিপুল অঙ্কের অর্থ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছে। এতে মারাত্মক ক্ষতি হয়ে গেছে। এ ধরনের ঘটনা যাতে আর না ঘটে, সে ব্যাপারে বাংলাদেশ ব্যাংকের সতর্ক থাকতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী চলতি ২০১০-১১ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে (জুলাই-আগস্ট) শিল্প স্থাপনের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় মূলধনী যন্ত্রপাতি (ক্যাপিটাল মেশিনারি) আমদানির জন্য এলসি খোলার পরিমাণ গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৯৭ দশমিক ১৬ শতাংশ বেড়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে জুলাই-আগস্ট সময়ে আগের অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি ২২ দশমিক ৩৬ শতাংশ কমেছিল।
0 comments:
Post a Comment